মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪০ অপরাহ্ন
খেলাধুলা ডেস্ক:
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটার নাম খুব সম্ভবত নাসের আল খেলাইফি। বিশ্বকাপের ফাইনাল নিয়ে, সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার কে পাবেন এই নিয়ে যত উত্তেজনাই থাকুক না কেন জগৎ জুড়ে, কাতারের এই ধনকুবের নিশ্চিন্ত। কারণ লিওনেল মেসি বা কিলিয়ান এমবাপ্পে, যার হাতেই বিশ্বকাপ ট্রফিটা উঠুক না কেন, শেষ পর্যন্ত প্যারিস সেন্ত জার্মেইর একজনই তো জিতবেন!
অনেক নাটকীয়তা, কান্নাকাটি আর প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পর বার্সেলোনা ছেড়ে লিওনেল মেসি গত বছরের আগস্টে যোগ দিয়েছেন পিএসজিতে। আবার গত আগস্টেই রিয়াল মাদ্রিদে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও এমবাপ্পে শেষ পর্যন্ত প্যারিসেই থেকে গেছেন। এরপর মেসি আর এমবাপ্পে দুজনই পিএসজিতে। একসঙ্গে খেলছেন, একে অন্যের পাসে গোল করেছেন; অথচ বিশ্বকাপ মুখোমুখি করে দিল দুজনকেই। তাও বিশ্বকাপের ফাইনালে। রবিবারের লুসাইল যেন প্রাচীন রোমের কোনো অ্যাম্ফিথিয়েটার, যেখানে মুখোমুখি দুই গ্ল্যাডিয়েটর।
আর্জেন্টিনা আর মেসি মিলেমিশে একাকার। দলটার হয়ে মাঠে আরও ১০ জন থাকেন ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ ম্যাচেই মেসি একাই গড়ে দিয়েছেন ব্যবধান। কখনো নিজে গোল করেছেন, কখনো অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। কোণঠাসা আর্জেন্টিনাকে প্রজ¦লিত করেছে মেসির একটা স্পার্ক। আর্জেন্টিনা এখন পর্যন্ত কাতার বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে করেছে ১২ গোল। তার ভেতর ৮ গোলেই মেসির সরাসরি অবদান, ৫টা করেছেন নিজে আর অ্যাসিস্ট করেছেন ৩টা গোলে। আর যে বাকি ৪ গোল, সেসবেও আক্রমণের শুরুতে কিংবা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার সূচনাটা হয়েছিল মেসির পা থেকেই।
মেসির স্বর্গীয় বাম পায়ে ভর করেই বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্যন্ত এসেছে আর্জেন্টিনা এবং বিশ্বকাপ জিততে হলে আসলে যা করার মেসিকেই করতে হবে। ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসি দেখেছেন কী করে গনজালো হিগুয়েইন আর রদরিগো প্যালাসিও সুযোগগুলো নষ্ট করে বিশ্বকাপটা হাতছাড়া করেছেন। ৮ বছর আগে হিগুয়েইন যদি নয়্যারকে সামনে একে পেয়েও গোলটা করতে পারতেন কিংবা প্যালাসিওস যদি লবটা নিশানায় রাখতে পারতেন, তাহলে হয়তো সর্বকালের সেরা ফুটবলার নিয়ে বিতর্কের ফয়সালা হয়ে যেত সেদিনের মারাকানাতেই।
সেটা হয়নি বলেই এখনো পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছে মেসিকে এবং কাতার বিশ্বকাপে সব পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত লেটার মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ মেসি। তবে ডিস্টিংশন নিয়ে উৎরাতে হলে জীবনের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে সবচেয়ে ভালো খেলতে হবে মেসিকে। সতীর্থরা তাদের কাজটা করবেন, কিন্তু মেসিকেই হয়ে উঠতে হবে মাঠের মূল চালিকাশক্তি।
বিশ্বকাপের ফাইনালটাই হয়তো আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির সবশেষ ম্যাচ। বিদায়ী ম্যাচে সাধারণত আবেগের প্রভাব পড়ে পারফরম্যান্সে। এরিক হলিসের গুগলিটা আবছা চোখে দেখতে পাননি ডন ব্র্যাডম্যান, এমনটাই বিশ্বাস করেন ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে। নরসিং দেওনারাইন নামের অতি সাধারণ মানের একজন অফস্পিনার, যার টেস্ট ক্রিকেটে উইকেটের সংখ্যা মাত্র ২৪, তার বলেই যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষবারের মতো আউট হবে শচীন টেন্ডুলকার, সেটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু ওয়াংখেড়েতে সেটাই হয়েছে, অফস্টাম্পের বাইরে নিরীহ ডেলিভারিতে কাট করতে গিয়ে সিøপে ক্যাচ দেন টেন্ডুলকার, সেঞ্চুরি থেকে ২৬ রান দূরে। আবেগের অন্তহীন প্রবাহ না থাকলে ইনিংসটা নিঃসন্দেহে বড় হতো।
মেসির সামনে তাই নিজের আবেগ এবং প্রতিপক্ষের প্রতিরোধ, দুটোই জয় করার। নিজের জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচেই মেসিকে খেলতে হবে জীবনের সেরা খেলাটা। তাহলেই বিশ্বকাপ জিতবে আর্জেন্টিনা, থেমে যাবে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সব বিতর্ক আর দায় মিটবে ফুটবলেরও।
অন্যদিকে এমবাপ্পে। জীবনের প্রথম বিশ্বকাপেই যত অর্জন তার, অনেকের দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারেও তা নেই। বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করেছেন, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জোড়া গোল ছিল শেষ ষোলোয়। আবির্ভাবেই বিশ্বকাপ জয়, সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরস্কার সব পেয়েছেন বছর উনিশের এমবাপ্পে। পরের বছরগুলোয় রিয়াল মাদ্রিদের তাকে নিয়ে টানাটানি, ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর ফোন সবকিছু এমবাপ্পেকে ঘিরে তৈরি করেছে আরও অনেক উন্মাদনা। মাঠেও এমবাপ্পে দিন দিন হয়ে উঠছেন আরও অপ্রতিরোধ্য এই বিশ্বকাপেও এখন পর্যন্ত ৫ গোল, ২টা অ্যাসিস্ট। গতি, শুটিং, ড্রিবলিং; কোনো বিভাগেই কমতি নেই এমবাপ্পের, কোনোভাবেই তাকে থামিয়ে রাখা যায় না। মরক্কোর বিপক্ষেও চারজনের কড়া পাহারার ভেতর থেকে কোলো মুয়ানিকে যেভাবে পাসটা দিলেন এমবাপ্পে, তাতে বিস্ময় ফুটেছিল প্রতিপক্ষের চোখেও।
রোনালদো অস্তাচলে, মেসিও তাই। বিশ্বকাপটা জিতলে এমবাপ্পে বুঝিয়ে দেবেন, সামনের সময়টা তার একচ্ছত্র রাজত্বের। নেইমার, আরভিং হাল্যান্ডদের ছাপিয়ে এমবাপ্পেই হয়ে উঠবেন নতুন রাজা।
বয়স মাত্র ২৩, সামনে অনেক সুযোগ আসবে এমবাপ্পের জীবনে। অলিভিয়ের জিরু, আন্তোয়ান গ্রিজমানদের পাশে খেলে গোল না করলেও হয়তো আরেকটা বিশ্বকাপ জয়ী দলের অংশ হবার সৌভাগ্য হতে পারে এমবাপ্পের। তবে মেসির সেই বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। বিশ্বকাপটা হাতে তুলতে হলে, জাদুর পা-টা চালাতেই হবে মেসিকে।
ভয়েস/আআ